‘দোকানে যতকুন থাহি নিজে শুনি, অন্য যারা আমার দোকানে আসে তাদেরও শুনাই। লোকবেতার না হুনলে কি চলে?’ লোকবেতার শোনেন কি না প্রশ্ন করলে এমন পাল্টা প্রশ্ন করেন বরগুনা সদর উপজেলার স্লুইজ ঘাট এলাকার মো. শামীম হোসেন। তিনি শ্রোতা ক্লাবের সভাপতি। শামীম হোসেনের নিজের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে কথা বলি তার সাথে।
উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় জনসচেতনা বৃদ্ধিতে কাজ করছে লোকবেতার। আরএর শ্রোতা ক্লাবগুলো এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তারা নিজেদের দোকানে বসে রেডিও বাজিয়েছেন। দোকানে আসা সব ক্রেতা কিংবা চা খেতে খেতে যারা গল্প করতেন তারা শুনছেন লোকবেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
লোকবেতারের ৬৬টি শ্রোতা ক্লাব আছে। এসব ক্লাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাতশ। প্রতিটি ক্লাবে দেয়া হয়েছে একটি করে রেডিও। শ্রোতা ক্লাবের সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে একত্রিত হয়ে প্রোগ্রাম শোনেন। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন মোকাবিলায় তৎপর ছিল লোকবেতার। আরএর কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং শ্রোতা ক্লাবের সদস্যরা তথ্য প্রচারে সহায়তা করেছেন।
লোকবেতার ঘূর্ণিঝড়ের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারিসহ দুর্যোগ মোকাবেলা সম্পর্কিত বিশেষ বুলেটিন প্রচার করেছে। এতে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলাসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। কোনো কোনো সময় ২৪ ঘণ্টাও সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার করেছে।
বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ খবর জানার ক্ষেত্রে উপকূলের মানুষের প্রধান উৎস ছিল কমিউনিটি রেডিও।
শামীম হোসেন জানান, মহাসেনের সময় আমাগো অনেক সদস্য সব সময় তৎপর আলহে। মনে করেন এই যে দুর্যোগ হইলো (মহাসেন), রেডিও কিছুক্ষণ পরপর ঘূর্ণিঝড়ের সবশেষ খবরা খবর বলতে থাকছে আর আমরা রেডিও বাজাইয়া শুনাইছি। আর আমাগো সদস্যরা মনে করেন যে বাড়ি বাড়ি গিয়া সবাইরে জানাইছে।
তিনি বলেন, লোকবেতারের আবহাওয়াবার্তাসহ নাটক, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, খবর—এগুলান মানুষ বেশি শোনে। তাই এগুলান বেশি বেশি প্রচার করা উচিত।
শামীম অনুষ্ঠানের প্রচার সময় আরো বাড়ানোর দাবি জানিয়ে বলেন, এহন মনে করেন লোকবেতার শুনি ৬ ঘণ্টা। এইডার যদি আরো সময় বাড়ানো হয় তাইলে ভালো হয়। ২৮ ঘণ্টা হইলে তো খুবই ভালো!
শ্রোতাক্লাবের একজন সদস্য মো. রনি। তার সাথে দোকানে বসে কথা হয়। তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ অনুযায়ী দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়াসহ যাবতীয় তথ্য রেডিও শোনাতো। আমরা সবাই মিলা এখানে বসে অনুষ্ঠানগুলা শুনতাম।
‘মহাসেন’ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে কমিউনিটি রেডিও স্টেশনগুলো তাদের সম্প্রচার সময় বৃদ্ধি করে দুর্যোগের খবর সার্বক্ষণিকভাবে প্রচার করেছে। এমনকি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জেনারেটরের মাধ্যমে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে সম্প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
ঝড়ো হাওয়ার কারণে বাসা-বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আসন্ন ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে মানুষের তথ্য জানার প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয় এই কমিউনিটি রেডিও লোকবেতার। এর মাধ্যমে জনগণ সার্বক্ষণিকভাবে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এবং নিজেদের করণীয় সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
ফলে জনগণের জানমালের অনেক সুরক্ষা হয়েছে। উপকূলের মানুষের কাছে কমিউনিটি রেডিওর অত্যাবশ্যকীয়তা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।