সুখী আক্তারের বাড়ি পাতাকাটা ইউনিয়েনের বালিয়াতলি গ্রামে। পড়েন বাবুগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, নবম শ্রেণিতে। বাবা দুলাল সরকার তার বিয়ে ঠিক করেছেন। কিন্তু সুখী চান না অপরিণত বয়সে এই বিয়ে করতে। তাছাড়া তার ইচ্ছে আরো লেখাপড়া করার। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন তার বাবা— বিয়ে করতেই হবে। নিরুপায় সুখী ভেবে পান না কী করবেন। এই মুহূর্তে আদৌ তার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আত্মীয়-স্বজন অনেককে দিয়েই সুখী তার বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাবা দুলাল নাছোড়বান্দা।
সুখী এর আগে শুনেছে লোকবেতারে এক অনুষ্ঠানে বাল্য বিয়ের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা। সেখানে বিশেষজ্ঞরা আসেন, বিভিন্ন পরামর্শ দেন। সুখী চান তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পান না। মাথায় আসে তার স্কুলের কথা। তিনি তার শিক্ষককে বিষয়টি জানান। শিক্ষক এগিয়ে এলে এবার সুখীর শক্তি আরো বেড়ে যায়। শিক্ষক সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন লোকবেতারে। ফোন করে পরামর্শ চান— সুখীর এখন কী করা উচিত। লোকবেতারের স্টেশন ম্যানেজার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানান। ইউএনও সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় চৌকিদার পাঠিয়ে বিয়েটা বন্ধ করে দেন।
সুখী বলেন, আমি সবে মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়ছি। আমার ইচ্ছা আমি অনেক লেখাপড়া করবো কিন্তু বাবা-মাতা চান না। তারা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। কোনোভাবেই তাদের বোঝাতে পারছিলাম না। পরে আমার এক শিক্ষক লোকবেতারের মাধ্যমে ইউএনওকে ফোন করান। ইউএনও লোক পাঠিয়ে বাবা কেবিয়ে বন্ধ করতে বাধ্য করেন।
এভাবে লোকবেতারের তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টায় অনেক বাল্য বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রেই বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তেমনই একটি হলো বরগুনার গিলাতলী গ্রামে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মাদ্রাসা ছাত্রী সুমি তারার বাল্য বিয়ে। সাহেবের হাওলা গ্রামের ১৬ বছর বয়সী সোহেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভূয়া জন্ম নিবন্ধন না দেয়ায় কোর্টে এফিডেভিট করে বয়স বাড়িয়ে তাদের বিয়ে পড়ানোর চেষ্টা চলছিলো। বিষয়টি লোকবেতারের মাধ্যমে জেনে ফুলঝুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন তপনও মেম্বর গোলাম ফরুক খান তাদের বিয়েটি বন্ধ করেছেন।
এভাবে একদিন বুড়িরচর ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে সীমা নামের ১৩ বছরের আরেকটি মেয়ের বিয়ে পড়ানোর চেষ্টা চলছে। মা চায় না বেগম তার মেয়েকে বিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মেয়েটি নাপিতখালী পঞ্চগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ঘটনাটি লোকবেতার ও পিএইচআর প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোহাম্মদ ভূইয়া শুনে তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেন।
হাতের কাছে একটি গণমাধ্যম থাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে কণ্ঠহীনদের কণ্ঠ সোচ্চার হওয়াও শোনার সুযোগ।
লোকবেতারের স্টেশন ম্যানেজার মনির হোসেন কামাল বলেন, লোকবেতারে আগাম বিয়ের খবর প্রচারিত হওয়ার পর অনেক বাল্য বিয়েই বন্ধ হয়েছে। স্থানীয় একটি গণমাধ্যম হয়েও লোকবেতার সমাজের যে উন্নয়নমূলক কাজ করছে তা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তিনি জানান, লোকবেতার বাল্য বিয়ে বন্ধে শুধু অনুষ্ঠান বা বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তাই প্রচার করে না, জাগো নারী পাঠশালা কেন্দ্রে, ইউএসএআইডি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগিতায় পিএইচআর প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সময় নানা রকম সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক করে সচেনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।