আমার বিয়ের বয়স প্রায় চার বছর। বিয়ের সময় ৩৫ হাজার টাকা যৌতুক দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমার বাবা বিয়ের সময় পুরো টাকা দিতে পারেনি। তাই বিয়ের পর প্রত্যেক দিন চলে আমার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আমার স্বামী আমাকে মারধর করতো। বিয়ের একবছর পর ১৫ হাজার টাকা চাইতে বলে আমার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন। আমার বাবা টাকা দিতে না পারায় বিয়ের ৩ বছরের মাথায় আমার শ্বশুড়-শাশুড়ির কথায় আমার স্বামী আমাকে এক সন্তানসহ তালাক দেয়। এরপর সে আবার একটি নতুন বিয়ে করে।
কথাগুলো যৌতুকের বলি হয়ে সর্বস্ব হরানো ৮নং সদর উপজেলার পোটখালি গ্রামের মরিয়ম বেগমের (ছদ্মনাম)। সাগরপাড়ের জেলা বরগুনায় এমন অনেক শরীফাই আছে যারা যৌতুকের নির্মম শিকার হয়েছে। বরগুনার অধিবাসীদের যেমন প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে তেমনই যৌতুকও এ অঞ্চলের একটি সামাজিক দুর্যোগ। যাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের।
যৌতুক না পেয়ে স্বামী ও শ্বশুরের নির্যাতনের পরে বরগুনার তালতলী উপজেলার মিনিপাড়া গ্রামে সোনিয়া আক্তার (১৮) নামে এক বালিকা বধুর বিষপানে আত্মহত্যা; পিতা যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় স্বামীর নির্যাতনে, লজ্জায় ক্ষোভে ও অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে বরগুনা সদর উপজেলার আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা বৈকালিন গ্রামের পিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী জেসমিন আক্তারের (১৬) আত্মহত্যা; কিংবা জেলার বেতাগী থানার চান্দখালি গ্রামে যৌতুকের বলি হয়ে গৃহবধু শরীফা খাতুনের (২৫) নির্মম মৃত্যুর মত ঘটনা অহরহই ঘটছে।
যৌতুক একটা অভিশাপ কিংবা সামাজিক ব্যাধি— একথাটা জন্মের পর থেকেই সবাই শুনে আসছে। কিন্তু কজনেই বা মনে রেখেছে এই আপ্তবাক্য। আমাদের সমাজে সেই আদিকাল থেকেই মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে আসছে বিভিন্নভাবে। এই আধুনিক যুগে এসেও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী সমাজ।
গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই স্ত্রীরা স্বামীদের বা তাদের পরিবারেরস দস্যদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, কখনো কখনো মারাও যাচ্ছে। একাধিক সন্তানসহ নারীকে প্রায়ঃশই ঘর সংসার হারাতে হয় যৌতুকের কারণে। এ থেকে রেহাই পেতে হলে সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্পনেই।
নারী নিজে বা তার পরিবার সহিংসতার কথা সহজে প্রকাশ করতে চায় না, প্রকাশ করলে বা বিচার চাইলে তাদেরকেই নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়এবং নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তারা নিজ পরিবার, সমাজ ও প্রশাসন থেকে প্রয়োজনীয় সহমর্মিতা, সমর্থন, সহযোগিতা পায় না।
এ বিষয়ে বরগুনা ডিকেপি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন হাওলাদার বলেন, লোকবেতার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তারা সামাজিক সচেতনতামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে। এরমধ্যে ‘নারীপক্ষ’ উল্লেখযোগ্য। নারীপক্ষ নারীকে অধিকার সচেতন করে। তাদেরকে আইনী পরামর্শ দেয়। সমাজের পিছিয়েপড়া অধিকারবঞ্চিত নারীরা এই অনুষ্ঠান শুনে নিজেরা সচেতন হতে পারে, পারে অন্যদেরও সচেতন করতে।
স্থানীয় নারী উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারী পাঠশালা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, যৌতুক ও বৈষম্য বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোরই একটি প্রতিফলন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আইনি সহায়তা ও সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কমিউনিটি রেডিও লোকবেতার বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, নির্যাতিত নারীর সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন আইনি সহায়তা। অনেক নারীই জানেন না তারা কোথায় গেলে এই সহযোগিতা পাবেন। এক্ষত্রে লোকবেতার প্রচারিত নারীপক্ষ অনুষ্ঠানটি বেশ সহায়ক। এখানে নারীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনা করা হয়। যৌতুক, এসিড আক্রান্ত নারীর আইনি সহায়তা কিংবা গৃহনির্যাতনের শিকার হলে কী করণীয় এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় এই অনুষ্ঠান থেকে জানা যায়।