আল মামুন
‘চোখ দুটো তো মাশাআল্লাহ গরুর মতোই… তারপরও ঠিকমতো দেখেন না?… চোখে চশমা লাগাতে পারেন না?… নাকি মেয়েদের দেখলেই ধাক্কা খেতে ইচ্ছে করে? দেখে তো ভদ্রলোকের ছেলের মতোই মনে হয়…!’
প্রথমা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায়। কথার মাঝে কোন দম ফেলে না। মুখ থেকে খই ফোটার মতো করে বের হয় কথাগুলো।
সুজন প্রথমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে— ‘মেয়েটি দেখতে কী সুন্দর, অথচ কথার কী ঝাঁজ!’
—‘কী দেখছেন এতো হা করে? … মুখে মশা যাবে তো… !’
প্রথমা একথা বলতে বলতে নুয়ে হাত থেকে পড়ে যাওয়া শপিং ব্যাগগুলো ওঠাতে যায়। সুজনও এ সময় ব্যাগ উঠিয়ে প্রথমার হাতে দিতে চায়। কিন্তু প্রথমা তাকে বাধা দেয়। চোখ বড় বড় করে বলে— ‘হয়েছে হয়েছে, থাক থাক। আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।… আপনি আমার কী ক্ষতিই না করেছেন, অথচ… একটিবারও স্যরি বললেন না! … ভুল স্বীকার করলেন না।… মানুষের লজ্জা থাকা উচিত…!’
প্রথমা কথার মাঝে কোনো বিরাম নেয় না। কথা বলা শুরু করলে একটানা বলতেই থাকে ।
—‘আপনার উচিত এখন আমাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া।’
একথা বলার পর প্রথমা আর দাঁড়ায় না। ঝামটা মেরে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়। আর সুজন ছোট শিশুর মত ছলছল দৃষ্টিতে প্রথমার হেঁটে যাওয়া দেখে। প্রথমা অনেক দূর চলে যাওয়ার পরও সুজন সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
কর্ণফুলি গার্ডেন সিটি শপিং কমপ্লেক্স থেকে শপিং করে বাসায় ফিরছিল প্রথমা। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে সে। দৃষ্টি অনেকটা দূরে। হয়তোবা রিকশা বা ট্যাক্সির দিকে। এমন সময়ে সুজনও সিঁড়ি থেকে উপরে উঠছে। মাথা নিচু করে সিঁড়ির একেকটা ধাপে পা ফেলছে সে। হঠাৎ সামনা-সামনি ধাক্কা লেগে যায় দু’জনের। অনেকটা মেঘে মেঘে সংঘর্ষের মতোই! কেউই ভাবতে পারেনি এভাবে আচমকা ধাক্কা লেগে যাবে কিংবা লাগতে পারে। প্রথমার হাতে চার-পাঁচটা শপিং ব্যাগ, দূরে ছিটকে পড়ে যায়। সিরামিকের মগ, ফুলদানি— সব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ব্যাগ থেকে বেরিয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়।
সুজন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে— ‘ইশ কী সর্বনাশটাই না হয়ে গেলো…! কতোগুলো জিনিস নষ্ট হয়ে গেলো মেয়েটার…! আমার কী কিছুই করার ছিল না? আমি ক্ষতিপূরণ দিলাম না কেনো? দিলে মেয়েটি কি তা নিতো? তাছাড়া মেয়েটি তো ক্ষতিপূরণের কথা বলেছেও। না বললে অবশ্য কথা ছিল না।’
নিজের কাছে নানা প্রশ্ন করে কিন্তু কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না সুজন। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় তার! অনেকটা ঘৃণাও জমে নিজের প্রতি। সবকিছু ছাপিয়ে সুজনের মাথায় হঠাৎ অন্য ভাবনা এসে ভর করে— ‘এমন সুন্দর মেয়ে তো আগে আর কোনোদিন আমি দেখিনি! দেখেছি বলে মনেও পড়ে না। মেয়েটা হাসল না… মিষ্টি ভাষায় কথা বলল না… শুধু মুখ বাঁকিয়ে কতোক্ষণ বকাবকি করল অথচ কী মিষ্টি সুর! কথার মাঝে যেনো ছন্দ আছে! আছে যাদুও! মেয়েটি যদি হাসতো, তাহলে না যেনো কতো সুন্দরই দেখাতো!’
কিছুক্ষণ পর সুজন বাসায় ফিরে যায়। কিন্তু তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে টেনশনে, উৎকণ্ঠায়। অসম অস্থিরতায়। মনে হয় চিরচেনা কী যেনো আজ হারিয়ে গেছে; কাছের কেউ তাকে একা ফেলে দূরে কোথাও চলে গেছে! সুজন কোনোদিন ভাবতেও পারেনি, তাকে এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
বাসায় ফেরে প্রথমাও। বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে। খায় আর মনে মনে ভাবে— ‘আসলে দোষ কি ওই ছেলেটার ছিল, নাকি আমার?… দোষ তো কারোই ছিল না! তাহলে… তাহলে ওর সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করলাম কেনো?… পথেঘাটে চলতে ফিরতে এভাবে একটু-আধটু ধাক্কা লাগতেই পারে। লাগাটা স্বাভাবিক। তাই বলে এরকম…।’
প্রথমা অনুতপ্ত হয়। অনুশোচনা ফিরে আসে। প্রায়াশ্চিত্ত করতে চায় এই ভুলের— ‘ছেলেটার সাথে আমার এরকম কথা বলা ঠিক হয়নি মনে হয়। ওর কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত! কিন্তু… ওকে পাবো কোথায়?… কী নিরীহ-ভদ্র ছেলেটা… ওকে আমি কতো বকাবকি করলাম অথচ… ও একটা কথাও বলল না!’
প্রথমার চোখে ঘুম নেই। রাত যেনো ফুরায় না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়— ‘রাতটা কেটে গেলেই আমি আবার সেখানে যাবো। ওর সাথে দেখা করব। দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নিবো। কিন্তু ওকে সেখানে পাবো তো!’
প্রথমার মনে সংশয় ক্রমশ দানা বাধতে থাকে। না পাওয়ার ভয়টা আস্তে আস্তে ঘণীভূত হয়। রাত জেগে জেগে ভাবতে থাকে। এ ভাবনার যেনো শেষ নেই।
ভাবনারই বিষয় বটে। কারণ ঢাকা শহর তো আর একটুখানি জায়গা নয় যে ইচ্ছে মত সবকিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। চলতি পথে একটা মানুষকে একদিন দেখার পর আরেকদিন তার দেখা পাওয়ার আশা করাটাও সবচেয়ে বড় বোকামি। বোকামি ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে যদি তার নাম-পরিচয়-ঠিকানা জানা না থাকে!
সুজন প্রতিদিন বিকেলে কর্ণফুলি গার্ডেন সিটির সিঁড়ি লাগোয়া টাইলস-বাঁধানো উচু স্থানটায় একলা একলা বসে থাকে। আজও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রতিদিন যে রকম সময় কাটানোর জন্য আসে আজও সেরকমই এসেছে। গতকালকের সেই মেয়েটার সাথে দেখা করবে বা দেখা হবে— এ রকম ভাবনা তার মাথায় ছিল না।
হঠাৎ প্রথমা সুজনের সামনে এসে দাড়ায়— ‘এক্সকিউজ মি!’
সুজন আঁতকে ওঠে। প্রথমে চিনতে পারেনি। পরে চিনতে পেরে ভয়ে কাঁপে! মনে মনে বলে— ‘আজ আবার কী বলতে এসেছে!’
প্রথমা আরও কাছে এগিয়ে আসে— ‘স্যরি, আই অ্যাম ভেরি স্যরি!’
সুজন মুচকি হাসে। কোনো কথা বলে না।
প্রথমা আবার বলে— ‘আপনার সাথে কালকে আমি যে দুর্ব্যবহার করেছি তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। সত্যিই আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আসলে… আসলে… চলার পথে এরকম হতেই পারে, সাধারণত হয়ও…। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ! জানেন, আমি গতকাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি? শুধু আপনার সাথে দেখা করার উৎকণ্ঠায়…।’
প্রথমা কথাগুলো একটানা বলে যায়। চঞ্চল মেয়ে সে। চটপটে মুখের ভাষা। কথায় যেনো মধু ঝরে। কথা বলা শুরু করলে আর থামে না, বলতেই থাকে। সুজন কিছু বলে না। শুধু মুচকি হাসে! আসলে সেটাকে হাসি বলা যায় না। সেটা এক রকম কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। সে কষ্ট সুজন ছাড়া অন্য কারো বুঝবার নয়। যে কষ্ট সুজন একাই বহন করে। সুজন অপলক দৃষ্টিতে প্রথমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রথমার কথা আত্মস্থ করে। প্রথমা তার ধ্যান ভেঙে দেয়— ‘কি? অমন করে তাকিয়ে আছেন কেনো? কিছু বলছেন না যে!
প্রথমার কথায় চোখে মুখে চাঞ্চল্যতা টগবগ করে।
সুজন প্রথমার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। চোখ নামায় না। নামাতে পারে না। মনে হয় সেখানেই সেঁটে গেছে!
প্রথমা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে— ‘আপনার হয়েছে কি, বলুন তো? মুখ বুজে শুধু হাসছেন, অথচ একটা কথাও বলছেন না! আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছেন, নাকি অন্য কিছু…?’
সুজনের দম বন্ধ হয়ে আসে। সারা শরীর ঘেমে যায়। কপাল বেয়ে ঘাম টপটপ করে নিচে পড়ে। সুজন পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছে।
প্রথমা সুজনের হাত ধরে— ‘এ কি! আপনি এতো ঘামছেন কেনো? আপনার হয়েছেটা কি বলুন তো! একটা পুরুষ মানুষ এতো নার্ভাস হলে চলে…!’
সুজন প্রথমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে শিউরে ওঠে। ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের গতি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়! সুজন নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। ভাবে পা দু’টি এখনি বুঝি দেবে যাবে মাটিতে। সুজন আর প্রথমার সামনে এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না। সে মাথা নিচু করে হঠাৎ হাঁটা শুরু করে।
প্রথমা হাত বাড়িয়ে ডাকে— ‘এই যে, শুনুন! শুনুন প্লিজ!… আমার কথা না শুনে যাবেন না! প্লিজ দাঁড়ান… একটু দাঁড়ান!’
সুজন হাঁটতেই থাকে। দাঁড়ায় না। প্রথমাও পিছু নেয়। দ্রুত পা বাড়িয়ে পেছন থেকে খপ করে সুজনের ডান হাতটা ধরে ফেলে। সুজন পেছন ফেরে। দু’জন মুখোমুখি হয়। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। দু’জনের কাছেই তাকিয়ে থাকার সে ভাষা দূর্বোধ্য। কেউ কারোরটা পড়তে পারে না।
প্রথমা তার হাতব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে সুজনের হাতে দিয়ে বলে— ‘এটা রাখুন…।’
সুজন কার্ডটা হাতে নিয়ে আর দাঁড়ায় না। দ্রুত হাঁটা শুরু করে। প্রথমাও এবার আর তাকে আটকাতে চায় না।
সে সুজনের হেঁটে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখে— ‘কী আজব মানুষরে বাবা! আমি বাচালের মত এতো কথা বললাম, অথচ… সে একটা কথাও বলল না! ছেলেদেরও যে এতো লজ্জা থাকে তা আগে জানতাম না তো!’
কেউ কারো নাম-পরিচয় জানলো না, অথচ একে অপরের প্রতি কেমন যেনো একটা অন্যরকম অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে! দু’জনকেই দু’জনের ভালো লেগেছে! কিন্তু কেউই কাউকে মুখ খুলে বলতে পারেনি।
প্রথমা বাসায় ফেরে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। অপেক্ষা করে একটা ফোন কলের। প্রথমা জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। ভাবে, অচেনা সেই মানুষটা এসে কানে কানে বলবে— ‘হ্যালো, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, সখি!’
কিন্তু প্রথমার ফোনে অচেনা সেই কন্ঠস্বর ভেসে আসে না। কেউ কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলে না— ‘ওগো, আমি এসেছি…!’
এক সময় অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে ওঠে।
অনুশোচনাবোধ থেকে মূলত তাদের উভয়ের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়।
সুজন জন্মমূক (বোবা)। জন্ম থেকে কথা বলতে পারে না। সারাজীবন তাকে এভাবেই কথাশূন্য হয়ে থাকতে হবে। সুজনের বুকের মাঝে প্রতিনিয়ত অজানা এক ঝড় বয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে বোবা আর্তনাদ, বোবা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই আর্তনাদ কেউ শোনে না। কেউ বোঝে না। মনের মাঝে জমে থাকা কথা কখনোই সে নিজের মত করে প্রকাশ করতে পারে না।
সুজন নিজেকে বড়ই দুর্ভাগা ভাবে— ‘আল্লাহ, আমাকে তুমি এই অবস্থা দিলে কেনো?… এর চেয়ে মৃত্যু ভালো ছিল…!’
সুজন ঠিক করে প্রথমার কাছে চিঠি লিখবে। ভাবতে ভাবতে লিখেও ফেলে ছোট একটা চিঠি। লিখে পাঠিয়ে দেয় প্রথমার ঠিকানায়। চিঠিতে সুজন শুধু নিজের নামটুকু লেখে, ঠিকানা লেখে না।
প্রিয়তমেষু,
আমি খুবই দুঃখিত, তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে। আমার সব থেকেও যেনো কিছুই নেই। আকাশসম শূন্যতার মাঝে আমার বসবাস। আমি তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার ভাবনার বীজতলায় তোমার চাষাবাদ শুরু করেছিলাম, কিন্তু… সেই ভাবনার ডালপালা-পাতা-শেকড় গজানোর পূর্বেই আমি তা নিজ হাতে উপড়ে ফেলেছি, কারণ আমি জন্মগত বোবা— কথা বলতে পারি না! কথা বলা মানুষের কাছে কথা না-বলা মানুষের আর কী দাম আছে? আমাকে অবশ্যই ক্ষমা কর এবং আমার জন্য দোয়া কর। ভালো থেকো, সবসময়।
ইতি,
সুজন, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ : দৈনিক যায়যায়দিন, ১ মে ২০০৮