রাজপথে বিক্ষোভ-আন্দোলন কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় নয়, বরং বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা ভাবছে রাজনৈতিক সমঝোতায়। অনেক দিন ধরে নানা সমীকরণে প্যারোলের বিষয়টি ঝুঁলে থাকলেও দিনদিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় অবশেষে বাধ্য হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তার পরিবার ও দলকে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার কথা বলে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কৌশলে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সামনে থেকে এ সমস্ত প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৭৪ বছর বয়সী তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন অন্যের সহযোগিতা ছাড়া হাঁটা-চলা, নড়াচড়া, এমনকি খেতেও পারেন না বলে দলটির নেতাদের ভাষ্য। একই সঙ্গে জীবন সংকটের আশঙ্কাও করছে তার পরিবার। তারা বলছে, এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিন পর বিএনপি নেত্রীকে আর জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে নিতে পারবেন না তারা।
অন্যদিকে, এতদিনেও খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়ার জন্য দলটির শীর্ষ নেতাদের দুষছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্যারোলের আদলে সাজা মওকুফের ‘বিশেষ আবেদন’ করার কথা ভাবছে তার পরিবার। গত ২৪ জানুয়ারি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রকাশ্যে সাংবাদিকেদের এমন কথা জানিয়েছিলেন তার বোন সেলিমা রহমান।
সেলিমার এমন মন্তব্যের পর বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার পরিবার তার মুক্তির জন্য আইনজীবী ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ওপর আর কোনোভাবেই নির্ভর করতে রাজি নন।
পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ফের খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতকালে বোন সেলিমা রহমানের সঙ্গে বিশেষ আবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে তার। তিনি সেলিমা রহমানের কাছে জানতে চেয়েছেন, সাজা মওকুফের বিশেষ আবেদন করলেই যে সরকার তা রাখবে, সে নিশ্চয়তা কোথায়?
তাছাড়া খালেদা জিয়া নাকি এ-ও বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি আর সাজা মওকুফের বিশেষ আবেদনের মধ্যে নীতিগত তেমন পার্থক্যও নেই। তবে আবেদনের বিষয়টি খালেদা নাকচ করেননি। মৌন সম্মতি দিয়েছেন। খালেদার পরিবারের এক সদস্য জানান, আগামী শনি কিংবা রবিবার আবেদনটি জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পৌঁছানো হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তার বোন সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, তার (খালেদা জিয়া) উন্নত চিকিৎসা খুবই প্রয়োজন। তার শরীর এতোই খারাপ যে, এই মুহূর্তে যদি তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া না-হয় তাহলে যে কি হবে সেটা বলতে পারছি না। আমাদের আবেদন, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেওয়া হোক।
তিনি বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিছানা থেকে বাথরুম দুই-তিন হাত জায়গা হবে তা যেতে ২০ মিনিট সময় লাগে। এখানে যে চিকিৎসা হচ্ছে তাতে তার শারীরিক কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেন না। হাঁটতেও পারেন না। একটু হাঁটলে আবার তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমরা তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সব প্রক্রিয়ায় চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি ২০ দলীয় জোটের এক সমাবেশে বলেছেন, নেত্রীর মুক্তির জন্য সব প্রক্রিয়ায়ই চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গেও দলের নেতাদের যোগাযোগ হয়েছে, কথা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায়ও তার মুক্তির চেষ্টা চলছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আইনগতভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় তিনি নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন। জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্ট তার নিম্ন আদালতের দণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে ১৮টি মামলায় জামিন পেলেও বাকি মামলাগুলোতে জামিন এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার আইনগত লড়াইয়ের মাধ্যমে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, বছরখানেক আগে বিএনপি প্রধানের চিকিৎসার জন্য প্যারোলের প্রস্তাব তুলেছিলাম। কিন্তু দলের মধ্যে অনেকেই তাতে রাজি হননি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণেই তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তাই মুক্তির বিষয়টি সহজ নয়। এখন তার জীবন রক্ষা করাটাই জরুরি ব্যাপার। সে কারণেই প্যারোলের কথা চিন্তা করা হলে সেটা তো দোষের কিছু নয়। এর আগে অনেক রাজনৈতিক নেতাই প্যারোলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি ইস্যুতে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ে সমাবেশ, মিছিল, র্যালি করেছি। আমাদের চেষ্টায় ঘাটতি নেই। মুক্তির আবেদনের বিষয়টি একান্তই তার পরিবারের। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জোর আলোচনা উঠেছিল গত বছরের মার্চ মাসে। আলোচনায় ছিল— সরকারের সঙ্গে গোপন সমঝোতা হয়েছে বিএনপির এবং তার অংশ হিসেবেই সংসদে যোগ দিয়েছেন দলের নির্বাচিত ছয় এমপি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে বারবার তা প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছিল, প্যারোল নয়, দলীয় প্রধানের নিঃশর্ত মুক্তির কথাই ভাবছেন তারা।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে দলের নির্বাচিত সাত এমপি তার মুক্তির ব্যাপারে কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করলেও শীর্ষ নেতারা তখন বলেছিলেন, সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন। এমন অভিযোগের মুখে সাত এমপিও খালেদার মুক্তি তৎপরতা থেকে সরে আসেন। এরপর পরই পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে জোর তৎপরতা চালানো হয়।
স্বজনদের আবেদন : খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসির কাছে আবেদন করেছেন তার স্বজনরা।
গত মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার স্বজনদের পক্ষ থেকে এ আবেদন করেন। চিঠিতে গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশের আবেদন জানানো হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বজনদের সূত্র থেকে জানা যায়, গত মঙ্গলবার বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার স্বজনরা সাক্ষাৎ করতে গিয়ে বিএসএমএমইউর ভিসি কনক কান্তি বড়ুয়ার কাছে আবেদন করেন বিএনপি প্রধানের ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার শামীম ইস্কান্দার।
তার সেজো বোন সেলিমা ইসলাম অন্যদের নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গণমাধ্যমের সামনে বলেন, খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে এবং সেজন্য তারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে হলেও তার মুক্তি চান।
খালেদা জিয়ার স্বজনদের পক্ষ থেকে আবেদনের কথা স্বীকার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বিবিসিকে বলেন, তিনি আবেদনটি মেডিকেল বোর্ডে কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ইতোপূর্বে মেডিকেল বোর্ড বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার কোনো সুপারিশ করেনি। উনাদের (খালেদা পরিবারের) আবেদন মেডিকেল বোর্ডকে দেব। বোর্ড পরীক্ষা করে কী সাজেশন দেয়, সেটা আমরা পরে জানাব।
এদিকে, সেলিমা ইসলাম খালেদা জিয়ার জন্য বিএসএমএমইউর ভিসির কাছে আবেদনের কথা স্বীকার করে বলেন, আবেদনে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চেয়েছি।
আর বলেছি যে, উনাকে (খালেদা জিয়া) নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। কারণ এটা মিথ্যা মামলা। সেজন্য আমরা নিঃশর্ত মুক্তির জন্য বলেছি। তিনি বলেন, তাদের আবেদন বিবেচনা করা হবে বলে তারা আশা করছেন।
বিএসএমএমইউ’র সূত্রে জানা যায়, লিখিত আবেদনে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার শামীম ইস্কান্দার লিখেছেন, খালেদা জিয়ার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনা অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন।
খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয় বহন করে এবং তাদের দায়িত্বে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে আবেদনে।