ড. এ পি জে আবদুল কালাম বহুমাত্রিক প্রতিভার নানামুখী বিকাশের এক বিরল ব্যক্তি। তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, জীবনভর শুধু স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন দেখাই ছিলো তার মহত্ব ও বিশালতা। তিনি তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন গোটা জাতিকে। তরুণদের তিনি বলতেন— ‘যা তোমরা ঘুমের মধ্যে দেখ তা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’
ড. কালামের স্বপ্ন ছিলো আত্মজয়ের। তাঁর স্বপ্ন বিশ্বজয়ের, মহাকাশ জয়ের। স্বপ্নগুলো অদম্য চেতনার, স্বপ্নগুলো মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনা বিকাশ সাধনের। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মূল্যবান বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশেষত ছাত্র ও যুবসমাজের হাতে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা তুলে দিয়েছেন। স্বপ্নের বিশালতায় ভাসিয়েছেন তরুণদের।
বিজ্ঞানব্রতী স্বপ্নদ্রষ্টা ড. কালাম ভারতকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেছেন। আত্মবিশ্বাস ও শক্তি জুগিয়েছেন। ভারতকে প্রযুক্তি মনষ্ক করেছেন, করেছেন স্বপ্নবিভোর। সৃজনশীলতায়, মননশীলতায় নতুন নতুন মাত্র যোগ করেছেন। বিশ্বের প্রথম কাতারের দেশগুলোর সঙ্গে ব্রাকেটভুক্ত করেছেন নিজের দেশকে।
ভারতসহ বিশ্বের লাখো তরুণের কাছে পুরোপুরি একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ছিলেন ড. কালাম। যিনি স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে পছন্দ করতেন। স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকতেন। এক স্বপ্ন সফল হলে শুরু হতো তাঁর নতুন স্বপ্নবোনা। তরুণদেরও স্বপ্ন সফল করার এই মন্ত্র শিখিয়ে দিতেন।
দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সমস্যা মনে না করে সম্ভাবনা মনে করতেন। সমস্যাকে পুঁজি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি মনে করতেন— ‘সফলতার জন্য বড় স্বপ্ন দেখা, জ্ঞান আহরণ আর কঠোর পরিশ্রম অপরিহার্য।’
তিনি শিশু-তরুণদের মধ্যে সত্যিকারের দেশপ্রেম জাগাতে চেষ্টা করতেন। শিশুদের জন্য নিজেকে সমর্পণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। শিশুদের উচ্ছ¡লতায় কাছে নিজের সব অর্জনকে গৌণ মনে করতেন। ড. কালাম বলেছেন— ‘আমার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ভারতের ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে সত্যিকারের জাতীয়বাদের উন্মেষ ঘটাতে সহায়তা করা, আমার সমস্ত কাজ এমনকি আমি নিজেও নিজেকে এ কাজে সমর্পণ করেছি। আমার সব সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার, আমার বিশেষজ্ঞ দল, আমার পুরস্কার-সম্মাননা সব এ লক্ষ্যের কাছে গৌণ। শিশুদের উচ্ছ¡লতায় আমার সমস্ত সত্তা বিলীন করতে, তাদের আনন্দময় রাজ্যে আত্মসমর্পণ করতেই আমার যাবতীয় প্রত্যাশা পর্ণতা পায়।’
ড. কালাম তাঁর টার্নিং পয়েন্টস বইয়ে লিখেছেন— ‘আমি শেখাতে আর গবেষণা করতে ভালোবাসি। আমি কখনো বারবার কথা বলে ক্লান্ত হইনা। আমার একাডেমিক জীবন চিন্তাচেতনা আর সৃজনশীলতায় ভরপুর। তরুণ ও তাঁদের শিক্ষকদের সাথে আমার পারস্পরিক সম্পৃক্ততাই আমার নিজের অন্তরের খাদ্য।’
নিয়মিতই তিনি ভারতের বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করতেন। ড. কালাম বলেন— ‘আমি লক্ষ্য করলাম ছোট ছোট শিশুকিশোরদের সঙ্গে আমার মেজাজ ভালো মেলে। আমি তাদের কল্পনার সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা হলো তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে আমি তাদের ভেতরে বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারি। এই আগ্রহই তাদেরকে ভবিষ্যতের উন্নত ভারত গড়তে সহয়াতা করবে।’
ড. কালাম অনুসন্ধিৎসু ছাত্রছাত্রীদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজগুলো দারুণভাবে উপভোগ করতেন। ছাত্রছাত্রীরাও তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতেন, অনুপ্রাণিত হতেন। আন্না ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় কর্তৃপক্ষ তাঁর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ৬০ জন। কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটি ক্লাসে ৩৫০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী উপস্থিত থাকতো। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় ছিলো না। বক্তৃতা শেষ করার পর অনেক প্রশ্নের জবাবও দিতে হতো। এক সময় ক্লাসের সময় এক ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে দুই ঘণ্টা করা হয়।
তিনি বলেন— ‘তরুণ-তরুণীদের আশা-আকাঙ্খাকে হৃদঙ্গম করা ও আমার জাতীয় মিশনগুলো থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে তাদের সাথে শেয়ার করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো। সৃষ্টির উল্লাসে তরুণ প্রজন্ম মেতে উঠেছে, ভাবলেই শিহরণ অনুভব করি।’
নিজের মেধা, পরিশ্রম ও যোগ্যতার গুণে যিনি অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণা, তিনি স্বপ্ন দেখাবেন না তো কে দেখাবেন!
চলবে...