ড. এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র। কিন্তু তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর পরিশ্রমী। লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ালেখা করতেন। অঙ্ক কষতে খুব পছন্দ করতেন। এতে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না।
ড. কালামের স্কুল জীবন শুরু হয় রামনাথপুরমের শোয়ার্জ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে। এরপর ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফস কলেজে। ১৯৫৪ সালে এই কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেন। পাঠক্রমের শেষের দিকে তিনি পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তারপরও পরবর্তীকালে চার বছর এই বিষয়ে অধ্যায়ন করে সময় নষ্ট করার জন্য আক্ষেপ করেন। এ ডিগ্রি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। এরপর ১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ চলে আসেন ড. কালাম। সেখানে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয় (বিমানপ্রযুক্তি) বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
এমআইটিতে প্রথম বছরটি শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এলো তাঁর। প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেছে নিলেন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। কারণ তাঁর লক্ষ্য খুব পরিস্কার, তিনি বিমান চালনা শিখবেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ঘাটতি ছিল। তাঁর আত্মজীবনী ‘উইংগস অফ ফায়ার’ বইয়ে লেখেন— ‘সম্ভবত অতি সাধারণ জীবনই এর কারণ। সে সময়টিতে আমি নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিশেষ চেষ্টা চালাই। নানা বাধা বিপত্তি, হতাশা আর বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু ধুম্রাচ্ছন্ন ঘটনাপ্রবাহের দিনগুলোতে আমার বাবার তারুণ্য-উদ্দীপক কথাগুলো আমার মনে অনুরণিত হতো।’
তাঁর বাবা বলতেন— ‘যে অন্যদের সম্পর্কে জানে সে শিক্ষিত, কিন্তু যে নিজেকে জানে সে জ্ঞানী। জ্ঞানবিহীন শিক্ষা কোনো কাজে আসে না।’
রামানাথপুরামের শোয়ার্জ হাইস্কুলের শিক্ষক আয়াদুরাই সলোমন উদ্যমী ছাত্রদের জন্য আদর্শ পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি তার উষ্ণ ও খোলামন আচরণ দিয়ে ক্লাসে তার ছাত্রদের মাঝে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ এনে দিতেন। ড. কালাম ওই শিক্ষকের কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সে কথা তিনি তার ‘উইংস অফ ফায়ার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। সলোমন বলতেন— ‘একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে একজন দুর্বল ছাত্র যা শিখতে পারে, একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে একজন ভালো ছাত্র পারে তার চেয়ে বেশি শিখতে।’
রামানাথপুরামে থাকাকালে তাদের শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ককে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওই শিক্ষকের সংস্পর্শে গিয়ে ড. কালাম শিখেছিলেন— ‘একজনের জীবনে যেসব ঘটনা ঘটে তার ওপর কারো বড় ধরণের প্রভাব থাকতে পারে।
সলোমন বলতেন— ‘জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য তোমার ভেতরের তিনটি প্রবল শক্তিকে বুঝতে ও আয়ত্ব করতে হবে। এ তিনটি শক্তি হলো— ইচ্ছা, বিশ্বাস আর প্রত্যাশা।’
ড. কালামের জীবনে সলোমনের অনেক প্রভাব পড়েছিল। তিনি তাঁর কাছ থেকে শিখেছিলেন— ‘তুমি যদি কোনো কিছু কামনা করো তাহলে তোমাকে তীব্রভাবে তা চাইতে হবে এবং তুমি যে সেটা একান্তভাবে চাও তা নিশ্চিত করতে হবে।’
ড. কালামের আত্মমর্যাদা বোধকে একটি উচু জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন আয়াদুরাই সলোমন। তিনি তাঁর মধ্যে এই বিশ্বাস জাগিয়েছিলেন যে, তোমারও যে কোনো উচ্চাকাঙ্খা থাকতে পারে।
ড. কালাম ছিলেন সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের সন্তান। এ নিয়ে তিনি যাতে মন খারাপ না করেন সেজন্য সলোমন মনোবল বাড়ানোর মত কথা বলতেন, উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন— ‘বিশ্বাস দিয়ে তুমি তোমার ভাগ্য বদলাতে পারো।’
ড. কালাম তাঁর বইয়ে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। একদিন অসাবধাণতাবশত তিনি অন্য একটি ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলেন। ওই ক্লাস নিচ্ছিলেন গণিতের শিক্ষক রামকৃষ্ণ আয়ার। ছাত্র পেটানোর পুরোনো আমলের রীতি অনুয়ায়ী তাকে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে পুরো ক্লাসের সামনে বেত্রাঘাত করলেন। এর কয়েক বছর পর ড. কালাম যখন গণিতে পুরো নাম্বার পেলেন তখন স্কুলে সকালের অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত সব ছাত্রের সামনে ওই ঘটনার বর্ণনা করেন শিক্ষক আয়ার। তিনি বলেন— ‘যাকে আমি একদিন পিটিয়েছিলাম সে একজন বড় মানুষ হবে! আমার কথাটি তোমরা মনে রেখো, এই ছেলে তার স্কুলে আর শিক্ষকের গৌরবান্বিত করবেন।’ একদিন ওই শিক্ষকের কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো! ড. কালাম স্কুল এবং তার শিক্ষকের গৌরবান্বিতই করলেন।
এমআইটিতে পড়ার সময়ে ড. কালাম তিন জন শিক্ষকের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁদের সান্নিধ্য পেয়ে ড. কালামের চিন্তার ভিত্তিটি তৈরি হয়েছিলো। পরবর্তীতে এর ওপরই তিনি পেশাগত কর্মজীবন গড়ে তোলেন। এ তিনজন শিক্ষক ছিলেন— প্রফেসর স্পন্ডর, প্রফেসর কে এ ভি পন্ডালাই এবং প্রফেসর নরসিংহ রাও। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এসব শিক্ষকরা যত্নের সঙ্গে বিমান চালনাবিদ্যা সম্পর্কে ড. কালামের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন।
চলবে...