নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিই হন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা।
নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করায় গণতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগ অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ন্যস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিকগোষ্ঠী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। ফলে তারা শুরু করেন নানা ষড়যন্ত্র।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে বসে ২২ ডিসেম্বর বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করতে চাই। পশ্চিম জার্মানিতে শীল ও ব্রাউন যদি কোয়ালিশন করতে পারে তাহলে শেখ মুজিবের সাথে আমার কোয়ালিশন হবে না কেন?’
এরপরের দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টোর জবাবে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সক্ষম নয় যে তাঁকে কারো সাথে কোয়ালিশন করতে হবে। ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তারা আমাদের সহযোগিতা করতে পারেন মাত্র।’
জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন শেখ মুজিবুর রহমান। এতে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এরপর তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত আঁটতে থাকে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি। বাংলার মানুষ সব সময়ই তাঁর পক্ষে— এটা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
অনতিবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ইয়াহিয়া ঢাকা সফরে আসে। সফর শেষে ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে অভিনন্দন জানায়। তবে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করে ইয়াহিয়া। পাকিস্তানিরা বুঝিয়ে দিতে থাকে যে তারা কোনো ভাবেই বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়।
১৯৭১ সালের ২৭ থেকে ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে ভবিষ্যত সংবিধান প্রণয়নের বিষয়ে কথা বলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৪ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। দর্পভরে বলেন— ‘মতামত গ্রহণ করা না হলে তার দল এ অধিবেশন বয়কট করবে।’
শেখ মুজিবুর রহমান যেনো ক্ষমতায় যেতে না পারেন সেজন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল কাইয়ুম খানসহ আরও অনেকে।
১৯৭০ সালের ২০ ডিসেম্বর লাহোরে এক জনসভায় ভুট্টো ঘোষণা করে যে, ‘আমার দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো সংবিধান প্রণয়ন কিংবা কেন্দ্রে কোনো সরকার গঠন করা যাবে না। জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য প্রস্তুত নয় পিপিপি।’ ভুট্টো আরও ঘোষণা করে যে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে একমাত্র তার দলই পশ্চিম পাকিস্তানিদের হয়ে কথা বলতে পারে।’
ভুট্টোর এ বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যোগ্য। কেউ সাহায্য করলে আওয়ামী লীগ স্বানন্দে সে সাহায্য গ্রহণ করবে, কিন্তু তা না করলে আওয়ামী লীগ এককভাবেই তা করবে।’
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে শুরু হয় আলোচনা। ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আব্দুল হামিদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদাকে নিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাসভবনে দীর্ঘ আলোচনায় বসে। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন— ‘শাসনতন্ত্র ছয় দফার ভিত্তিতেই হবে।’ বিপরীতে ভুট্টো বলেন— ‘আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।’ এমনি সময়ক্ষেপণ চলতে থাকে।
১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে যে, ‘৩ মার্চ বুধবার ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে।’ কিন্তু ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় আশ্বস্ত হতে পারেনি বাঙালিরা। কারণ দিন দিন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত করতে থাকে পাকিস্তানিরা। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আবার আলোচনায় বসে ইয়াহিয়া খান।
পরবর্তীতে ২৬ ফেব্রুয়ারি করাচির প্রেসিডেন্ট হাউসে দুজনের মধ্যে আরেক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব দেন ইয়াহিয়া খান। এদিন তিনি এক বেতার ভাষণের মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে, ‘৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো।’ তার এ ঘোষণার সাথে সাথে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা।
এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কোনো পরামর্শ না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্মেলনের মাধ্যমে ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন। সেই সঙ্গে তিনি ৭ মার্চের রেসকোর্সের জনসভারও ঘোষণা দেন।
২ মার্চের হরতালে ফার্মগেটের কাছে পুলিশের গুলিতে আহত হয় ৯ জন। উত্তাল এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় কারফিউ জারি করা হলেও সাধারণ মানুষ কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। বিকেলে ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এরপর আবার ৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের স্থগিত অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন তিনি।
চলবে…