মা-বাবা ‘খোকা’ নামে ডাকলেও বন্ধুরা তাঁকে ডাকত ‘মুজিব’ বলে, কেউ কেউ বলত ‘মুজিব ভাই’। ছোট্ট খোকা তথা শেখ মুজিব ছোটবেলায় খুব চঞ্চল এবং দুষ্টু ছিলেন। তার দুরন্তপনা পছন্দ করতো সমবয়সী ছেলেমেয়েরা। সে সবার সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারতো। তাই তাঁকে ছাড়া তাদের খেলা যেনো জমতো না।
শৈশবে শেখ মুজিব ছিলেন হালকা-পাতলা, ছিপছিপে গড়নের সুদর্শন এক বালক। তাঁর চেহারায় ছিল এক ধরনের অভিজাত্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা দৃষ্টি কাড়ত সবারই। স্বল্পভাষী বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। মাছমাংসের চেয়ে বরং নিরামিষ বা শাকসবজিই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। বাল্যকালে তাঁর প্রিয় খাবার ছিল কলা ও ডুমুর। তিনি সারাজীবন দেশি ফলমূল খেয়েছেন। এছাড়া কই, শিং, মাগুর ও কাচকি মাছ পছন্দ করতেন তিনি। তাঁর প্রিয় ফুল ছিল গোলাপ।
শেখ মুজিবুর রহমান বাবার মতোই দৈহিক গড়নে একপ্রকার শক্তি-সামর্থ্যে দিনদিন বেড়ে উঠতে থাকেন। ছেলেবেলায়ই তাঁর প্রতিভা ও অসামান্য ধী শক্তি প্রকাশ পেতে থাকে। শিশু মুজিব অসাধারণ মানসিক এবং স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। শৈশব থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী। সেই সঙ্গে কোমল হৃদয়েরও অধিকারী ছিলেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর বইয়ে লিখেছেন— ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগতো। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তাঁর কথামতো যা বলতেন তাই করতো। আবার এগুলো দেখাশোনার ভার দিতেন ছোট ছেলেমেয়েদের উপর।… আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতি ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এই খালের পাড়েই ছিল বড় কাচারি ঘর। আর এই কাচারি ঘরের পাশে মাস্টার, পণ্ডিত ও মৌলবি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাঁদের কাছে আমার আব্বা আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন।’
সাত বছর বয়সে ১৯২৭ সালে শেখ মুজিবকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় গোপালগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। ৯ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এই স্কুলে পড়াশোনা করেন ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
শেখ মুজিবুর রহমান চার বছর ঠিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। কারণ ১৯৩৫ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত তিনি। এই রোগে তাঁর চোখে ছানি পড়ে এবং প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মাদারীপুর ও আশপাশের নামকরা ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করিয়েও কোনো লাভ হয় না। এ অবস্থায় তাঁর উদ্বিগ্ন বাবা শেখ লুৎফর রহমান কলকাতায় নিয়ে যান উন্নত চিকিৎসার জন্য। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান— চোখের অবস্থা ভালো নয়, চোখে যাতে চাপ না পড়ে সেজন্য লেখাপড়া বন্ধ রাখা দরকার। তাই বঙ্গবন্ধুকে বছর চারেক লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হয়।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে এসব বিষয়ে লিখেছেন। তিনি লেখেন— ‘১৯৩৬ সালে আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে।… এই সময় আমি মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে হয়েছিলাম লেখাপড়া করার জন্য। কলকাতা যেয়ে ডাক্তার টি. আহমেদ সাহেবকে দেখালাম।… ডাক্তার সাহেব আমার চক্ষু অপারেশন করতে বললেন। দেরি করলে আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি। আমাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিলেন।… দশ দিনের মধ্যে দুইটা চক্ষুই অপারেশন করা হলো। আমি ভালো হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছি।’
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন শেখ মুজিব। এর আগে কলকাতা শহরে দুই বছর অবস্থান করার ফলে ইংরেজি ভাষার ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময় তিনি অন্য ছাত্রদের তুলনায় প্রাঞ্জলভাবে ইংরেজি বলতে শেখেন।
শেখ মুজিব এন্ট্রান্স পাশ করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন মানবিক বিভাগে। কলেজের বেকার হোস্টেলে ২৪নং কক্ষে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। শেখ মুজিবের সাথে এক কক্ষেই থাকতেন টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গার এক সহপাঠী শাহাদাৎ হোসেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় সোহরাওয়ার্দীর সহকারি হিসেবে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন শেখ মুজিব। ১৯৪৪ সালে কলকাতাস্থ ফরিদপুরবাসীদের সংগঠন ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন’ এর সম্পাদক নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
শেখ মুজিব কলেজ হোস্টেলে থাকলেও পরীক্ষার আগে আগে চলে যান পার্ক সার্কাসে, তাঁর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবতের বাসায়। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন ১৯৪৭ সালে। এরপর দেশ ভাগ হলে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে টুঙ্গিপাড়া চলে আসেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে আসেন ঢাকায়।
চলবে…